Thursday, March 31, 2022

 

কিছু পুরোনো স্মৃতিঃ 
 
আজকে ১৯৭৭ সালের কিছু স্মৃতিচারণ করতে চাচ্ছি। আমার মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সবেমাত্র বুয়েটে ভর্তি হয়েছি। তখন আমার অন্যতম শখ ছিল ডিএক্সিং। ডিএক্সিং এক ধরনের রেডিও ইঞ্জিনিয়ারিং বলা চলে। তখনকার দিনে তো আর ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিলোনা, আর ইন্টারনেট তখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি। তাই রেডিও শোনা একটা অন্যতম সখ ছিলো আমারও অন্য সবার মতো। ডিএক্সিং এর বাংলা সংস্করণ পেলাম না। ইংরেজী সংস্করণটাই এখানে দিলাম।
(DXing is the hobby of receiving and identifying distant radio or television signals, or making two-way radio contact with distant stations in amateur radio, citizens' band radio or other two-way radio communications. Many DXers also attempt to obtain written verifications of reception or contact, sometimes referred to as "QSLs" or "veries". The name of the hobby comes from DX, telegraphic shorthand for "distance" or "distant".)
আমার ওটা অবশ্য আরও বেশী করে সখে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনার ফলে। তা ওটা আমার এমনকি একটা নেশা হয়ে গিয়েছিলো। এখনো মনে পড়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথাগুলো, “ভোমা ভোমা মছুয়াগুলা...”। বাবা অবশ্য একটা দামী রেডিও কিনে দিয়েছিলেন। যাইহোক তখনকার দিনে ১৯৭৪ সালে আমি ডিএক্সিং এর উপর রেডিও বুখারেষ্ট এবং রেডিও চেকস্লোভাকিয়া থেকে দূরশিক্ষণে ডিপ্লোমা পেয়েছিলাম। লক্ষ্য করুন পৃথিবী দূরশিক্ষণে কতো এগিয়ে ছিলো। আর বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে Bangladesh Institute of Distance Education (BIDE) একটা দূরশিক্ষণের উপর প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়, যদিওবা কাগজে কলমে জানা যায় ১৯৫৬ সাল থেকেই বাংলাদেশে দূরশিক্ষণ চালু আছে। তবে, তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় ১৯৯২ সালে Bangladesh Open University (BOU) গঠনের পর। আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেখানেও কিছুকাল কম্পিউটার বিভাগের পরিচালক পদে কর্মরত থাকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দূরশিক্ষণে বাংলাদেশ বাইরের পৃথিবী থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।
আবার প্রসংগে আসা। বাংলাদেশে ডিএক্সিং শুরু করেছিলাম প্রায় প্রথম সারিতে থেকে। সাথে একটা মাসিক ইংরেজী পত্রিকা বের করি, যার নাম দিয়েছিলাম, বেঙ্গল ডিএক্স কমেট (Bengal DX Comet)। এটা নিয়েও ঘটনা আছে, ডিএক্স বা ডিএক্সিং তখনকার দিনের বহুল ব্যবহৃত শব্দ। তবুও কলাবাগান থেকে এক ভদ্রলোক কিছুদিন পরপর ভয় দেখানো চিঠি পাঠাতেন, যে আমার বাসায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে হাজির হবেন, যদিনা আমি বেঙ্গল ডিএক্স কমেট-এর নাম পরিবর্তন করি। তখন আমার দেশে-বিদেশে প্রচুর বন্ধু। তারা তো শুনে অবাক! তবে, উটকো ঝামেলা এড়াতে, বেঙ্গল ডিএক্স কমেট-এর নাম বদলে রাখলাম, QRZ WD (অর্থাৎ ফ্রিকোন্সি অফ দা ওয়ার্ল্ড)। তারপর যতদিন পত্রিকাটা ছাপিয়েছি, উনি আর ঝামেলা করেননি। সাথে একটু বলে রাখি, এতে আমার বাবার অবদান আছে। উনি, জিপিও-র মহাপরিচালককে অনুরোধ করে সস্তায় পত্রিকাগুলো বুকপোষ্ট করে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি নিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাঁর প্রতি অতিশয় কৃতজ্ঞ। কারণ, এতে করে আমার ইংরেজীর উপর দক্ষতা পেতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে।
এবার আসি আবার আজকের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে বেঙ্গল ডিএক্স ক্লাবের সভাপতি ছিলাম, তেমনি ভারতের ইন্ডিয়ান ডিএক্স ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবের সভাপতি ছিল আমার কলকাতার এক বন্ধু। আমি তখন ছদ্মনামে লেখালেখি করতাম। “খোকন বিশ্বাস” নাম দিয়ে। মা আমাকে খোকন নামেই ডাকেন। আর আমার দাদার নামের শেষে বিশ্বাস ছিলো, তাই এই নামকরণ।
আমার আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমার লিস্টে পশ্চিমবঙ্গের অনেক বন্ধু আছেন, যদি কারো স্মৃতিতে মনে পড়ে খোকন বিশ্বাস নামে কাউকে চিনতেন, বা আমি তুমি করেই বলছি তোমরা যদি কেউ আমার এই লেখাটা পড়ে থাকো, বা আমার বন্ধুদের ভিতরে কেউ আলোচনার ভিতরে আসে, যে খোকন বিশ্বাস নামে কাউকে তারা চিনতেন, তাহলে বড়ই প্রীত হতাম।
এটা অতীব দুঃখের ব্যাপার, যে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ৪/৫ জন ছিল কলকাতার, বারাসাতের- কিন্তু এত বছরের ব্যবধানে আর বিশেষ করে এক দুর্ঘটনায় আমার স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার ফলে, তাদের কারও নামই আমি মনে করতে পারছিনা বা আমার মনে নেই। আমারও দোষ আছে, সেই ১৯৭৭ সালে প্রথম কলকাতা যাবার পর ফিরে এসে আমি আর যোগাযোগ রাখতে পারিনি।
এখানে দু’টো কথা না বললেই নয়। ঐ সালেই কলকাতা থেকে বন্ধুরা আমন্ত্রণ জানালো যাবার। ক’দিন সরকারী অনুদান পাবার চেষ্টা কললাম। বিফল হয়ে মা’কে জানালাম। মা বললেন, বুয়েটের স্কলারশীপের টাকাটা নাহয় ব্যবহার কর। আর তার ফলেই আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা।
যে ক’দিন ছিলাম, বন্ধুদের সাথে সময়টা ভালই কেটেছিলো। অনেক বন্ধু জুটে গিয়েছিলো। তারপর ফেরার দিনের একটা কথা এখনও মনে পড়ে। বন্ধু আমি সেজন্য প্রতি অতিশয় অতিশয় অতিশয় দুঃখিত। তখনকার দিনে ঢাকা এয়ারপোর্টে ছাদের উপরে উঠে সিঅফ করা যেতো, তেমনি কলকাতা দমদম এয়ারপোর্ট এর ছাদের উপরে উঠেও সিঅফ করা যেতো। তখন তো আর বোর্ডং ব্রীজ ছিলোনা। আমি যখন বিমানের দিকে হাঁটছিলাম, তখন কেনো জানি মনে হচ্ছিলো, কে যেনো দূর থেকে খোকন বলে আমার নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারিনি বিমানের শব্দে। যখন আমি বুঝতে পারলাম, তখন অনেক দেরী। আমি বিমানের সিঁড়ি বেয়ে ভিতরে ঢোকার অপেক্ষায়। (এই কথাগুলো বলতে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।)
আমি তখন পিছন ফিরে এক ঝলকে তাকিয়ে দেখলাম আমার বন্ধুটা ছাদের উপর দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে, আর আমার নাম ধরে ডাকছে। যাই হোক বন্ধুরা, যদি এখন আমার এই লেখাটা কেউ পড়ো, তাহলে আমার সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করবা।
আর একটা কথা বলে শেষ করছি। বিদেশের মতো, দেশেও তখন অনেক বন্ধু ছিলো। তখন তো ইমেইল ছিলোনা, তাই চিঠি মারফতেই যোগাযোগ ছিলো। ১৯৮২ সালে যখন বৈরুত গেলাম মাস্টার্স করতে, আমার ছোটবোন বলেছে, সে কিছুকাল আমার হয়ে চিঠির উত্তর দিতো। তারপর আর কারও সাথে কোনও যোগাযোগ নেই। বন্ধুরা, এই বুড়োকালে যদি খোকন বিশ্বাস নামটা কারও মনে থেকে থাকে, তাহলে যোগাযোগ করতে ভুলোনা। ভালো থেকো তোমরা সবাই। আপনারাও ভালো থাকবেন।

No comments:

Post a Comment